ভালোবাসা কারে কয় ।। What Is Love .

তোমরা যে বলো দিবস-রজনী
ভালোবাসা’ ‘ভালোবাসা’—
সখীভালোবাসা কারে কয় !
সে কি কেবলই যাতনাময় ।
সে কি কেবলই চোখে.
র জল ?
সে কি কেবলই দুখের শ্বাস ?
লোকে তবে করে কী সুখেরই
তরে এমন দুখের আশ ।
রবিন্দ্রনাথের গানটি আমার মনে খুব অদ্ভুত একটা অনুভূতি জাগায়। ভালবেসে যদি সুধুই বেদন, রোদন, কষ্ট আর কান্না...তবে কেন এই ভালবাসা?
আমার খুব কাছের একজন মানুষের কথা আজ বলবো। মেয়েটি ভালবেসে বিয়ে করেছিলো। নিজেকে মনে করতো পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী কন্যা, বোন, সখী আর গৃহিণী। এমন কোন সুখ ছিল না যা সে পায়নি। সুখে কাটানো দিনগুলোর মাঝে ঝড় উঠল একদিন, এলোমেলো করে দিয়ে গেল ওর সুখের ডালি। ভেঙ্গে গেল সংসার। মেয়েটি ভাবল ওর সব সুখ  হারিয়েছে যা আর কোনদিন ও ফিরে পাবেনা। অসম্ভব মনের শক্তি দিয়ে নতুন চোখে দেখল পৃথিবীটাকে। আরম্ভ হল ওর নতুন পথে যাত্রা। কি শক্তি সাহস আর নিজের ভেতরের অনুপ্রেরনা নিয়ে ওর জীবনটা ও ফিরে পেল সেটা খুব কাছ থেকে দেখেছি আমি। ভাবল...অনেক ভাবল, বুঝল... আর তখন সিদ্ধান্ত নিল নতুন কোন সখার কোন ঘর ওর প্রানে ও আর গরবে না। আর ভালবাসবে না...আর কোনদিন কোন একজনের সাথে ও আর সংসার করবে না। এবার ওর সংসার হবে এই পৃথিবীর সবাইকে নিয়ে...গোটা পৃথিবী জুড়ে।
“ঝরকে আমি করব মিতে
ডরব না তার ভ্রুকুটিতে”...ভাবল ও আর হারবে না নিজের কাছে। আবারো হেরে গেল। ভালবাসে ফেলল...বিয়ে করতে চাইল ভালবাসার মানুষটিকে। শুনল সেই মানুষটা নাকি তার জগতে মেয়েটিকে নিতে পারবে না...সুধু ভালবাসতে পারবে কিন্তু বিয়ে নয়...একজন মানুষ হিসেবে ছেলেটি মেয়েটিকে তার জীবনে গ্রহন করতে পারবে না কারন মেয়েটি ডিভোর্সি। ।
নতুন আরও একটা পৃথিবী দেখল মেয়ে। ওর মনে প্রশ্ন এল...ছেলেটির মা বোন বা ভাগ্নির সংসার কি ভাঙতে পারত না? কিন্তু কি প্রশ্ন রাখবে মেয়েটি ঐ ছেলেটির কাছে?
আমার দিন আমার রাতগুলো সব এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো মেয়েটির সব কথা শুনে। কতবার...কতবার যে আমি আমার সারাবেলার কাজের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি আর ভেবছি তা আমি নিজেও জানিনা। খুব খুব বেশী কষ্ট পেয়েছিলাম।
আমার কষ্ট মেয়েটার জন্য হয়নি। হয়েছে করুনা এই সমাজের জন্য...এই পৃথিবীর জন্য। শুধু আমাদের দেশ নয় অনেক উন্নত দেশেও এই কুটিল সমাজ এমন অনেক অদ্ভুত আচরণ দেখিয়েছে যা আমি কোনোদিন মেনে নিতে পারিনি। ছোটবেলা নানু আর দাদী মাছের মাথা, মুরগীর রান, বেশী ভাল পেয়ারাটা, সফেদাটা বা ভাল পিঠাটা আমার ভাইকে দিতেন, আমাকে নয়। আমার ঐ ছোটবেলায় মনে প্রশ্ন জাগত কেন এই বৈষম্য। আমি মেয়ে বলে নাকি ভালটা খেতে নেই...ভাইকে দিতে হয়। তখন রাগ হতো নানু দাদীর উপর কিন্তু এখন বুঝি তারাও শিখেছিলেন তাদের মায়ের কাছে, সমাজের কাছে।
আমি জানিনা আমরা মেয়েরা কেন এতো সংসার আর ভালোবাসা নিয়ে ব্যাস্ত। কেন আমরা, মেয়েরা পারিনা আমাদের আকাশ, আমাদের গান, আমাদের রান্না, আমাদের হাতের কাজ...আমাদের খুব ভেতরের আমাদের যা পছন্দ তাকে ভালবাসতে আমি বলছি না যে আমাদের সংসার, সন্তান ভালবাসা ভুল। কখনই ভুল নয়। যেখানে আমার ভালোবাসার যত্ন আছে সেখানেই আমার ভালোবাসা। আমার মা আর সেজ খালা ছোট খালাকে দেখেছি কিভাবে সংসার ভালবাসতে হয় আর অপরদিকে দেখেছি আমার মেজ খালাকে কিভাবে তার সংসার আর পৃথিবীর প্রতি ভালোবাসা একাকার হয়ে গেছে। সমাজের অবহেলিত মেয়ে, ছেলে, বয়স্কজন, অভাবের কারনে ছেলেকে না পরাতে পারা মা, অবহেলিত শিল্পী, পথের শিশু...সবাইকে কাছে টেনে নেন সহজেই। কতবড় মন হলে এতো মানুষকে একসাথে ভালোবাসা যায়? তবে আমরা কেন পারব না?

“তুমি সুখ যদি নাহি পাও... যাও সুখেরও সন্ধানে যাও” কথাগুলো শুনলে ছোটবেলায় রবীন্দ্রনাথের উপর খুব রাগ হতো। কেন আমি আমার ভালোবাসার মানুষকে সুখের সন্ধানে অন্য কার কাছে যেতে বলব? কেন সে আমার মাঝে সুখের সন্ধান করবে না? কিন্তু এখন বোধটা হয়েছে পরের দুটো লাইনের জন্য। “আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়ও মাঝে আরও কিছু নাহি চাই গো”। সে যদি চলেও যায় আমার কাছ থেকে তবু সে রয়েছে আমার হৃদয়ে। সে পারেনি কিন্তু আমি পেরেছি ভালবাসতে। জয় আমার।
আমরা মেয়েরা সুধু দিতে শিখি নিতে নয়। যত শিক্ষিত হই না কেন...সমাজ সংসার আর মানুষের কথা শুনে নিজেদের নিজেরাই ছোট করি। আদিম যুগ থেকে এখন পর্যন্ত কি বন্ধ হয়েছে মেয়েদের উপর অত্যাচার বা অবহেলা? না হয়নি। হবেও না। আপনারা আশায় বুক বাধতে পারেন কিন্তু আমার কোন আশা নেই এই নিষ্ঠুর সমাজের প্রতি। আমি শুধু ছেলেদের কথা বলছি না বরং মেয়েরাও মেয়েদের প্রতি নিষ্ঠুর। আপনি ডিভোর্সি বলে কেউ যদি আপনার দিকে চোখ ছোট করে তাকায়, আপনাকে বিয়ে করবে না বা পরিবারের কাছে আপনাকে গ্রহন করাতে পারবে না বলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, আপনি আপনার শক্তি দিয়ে তার আগে তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিন।
শেষ করব আমার আরেকজন প্রিয় মানুষের জীবনের গল্প বলে। ওর সংসারটা ভাঙতে বসেছিল।অনেক কষ্ট সহ্য করে ও ওর ভালোবাসার সংসারটাকে ভাঙ্গনের হাত থেকে বাচিয়েছে।খুব ভাল আছে এখন। আবার সেই আগের মতো হাসিখুশি সুখী একটা মেয়ে এখন। মেয়েরা, আমি আপনাদের কাছে নিবেদন করছি আপনি গান করুন, ছবি তুলুন, লিখুন গল্প কবিতা, শাড়ী ডিজাইন করুন, সেলাই করুন, রান্না করুন, হাসুন মানুষকে ভালবাসুন, সমাজের সেবা করুন, নিজের বাসাটা সুন্দর করে সাজান নিজের জন্য, নিজেকে সাজান...সুধু শাড়ী চুড়ি আর কাজল দিয়ে নয়...নিজের ভেতরটা সাজান। সংসার ভাল লাগলে সংসার, সখা ভাল লাগলে সখা, গান ভাল লাগলে গান আর পৃথিবীর মানুষকে ভালবেসে সেবা করতে চাইলে সেবা...যাই করুন না কেন নিজের সম্মানটা হারাবেন না। সুখী রাখবেন নিজেকে নিজের জন্য। অন্য আরেকজন মানুষের জন্য নিজের সুখ আর আত্মসম্মান হারাবেন না। কারন কোন একদিন দেখবেন আত্মসম্মানটা ভালোবাসার চাইতে বড় হয়ে যায়...যেখানে আপনার নিজের আত্মসম্মানটা আপনার ভালোবাসা হয়ে ওঠে।

Comments

Popular posts from this blog

Goat Farming in Bangladesh || বাংলাদেশে ছাগল পালন ।। ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন || Black Bengal Goat Farming

পাহাড়ের টানে খাগড়াছড়ি-সাজেক || সাজেক ভ্রমণের বৃত্তান্ত