পাহাড়ের টানে খাগড়াছড়ি-সাজেক || সাজেক ভ্রমণের বৃত্তান্ত

আজীবন পাহাড়ের প্রতি একটা অচেনা টান অনুভব থেকেই বান্দরবান যাবার প্ল্যান। কিন্তু টানা তিন দিনের সরকারী ছুটি পড়ে যাওয়াতে টিকেট হোটেল ইত্যাদি নিয়ে পুরো ভ্রমণই ভেস্তে গেল। অবশেষে জাহাঙ্গীর চৌধরীর অমানসিক পরিশ্রমে শেষ পর্যন্ত খাগড়াছড়ির টিকেট পাওয়া যায়। এসি বাস তার উপর শেষের সিট। রিপন ভাই না যাবারই কথা এসি বাসে। কিন্তু সবাই মহাখুশি যা হবে তাইতে চলে যাবে এমন ভাব। টিআর ট্রাভেলস বাস (এই রুটে শান্তি পরিবহণ বাদে কোন এসি নাই কিন্তু তারাই তৃতীয় পক্ষ থেকে ভাড়া করে একটা ট্রাভেল এজেন্সির কাছে ভাড়া দিয়েছে তাই কপাল গুণে শেষের সিট হলেও পেয়ে গেছি) পিছনেও মহা শান্তি নিশ্চিত।
১০ টার বাসের জন্য সিএনজি করে ৯ টার মধ্যেই পৌছালাম। কিন্তু বাসের দেখা মেলা ভার। দামি আর এসি বলে কথা। সেই বাস এলো ১২ টার ৫ মিনিট আগে। তিনটা ঘণ্টা পায়ের উপর দাঁড়ানো। তবুও শান্তি পেলাম অবশেষে। উঠেই আনন্দে সময় কাটানোর প্ল্যান করতে করতেই জ্যামের কল্যাণে ১.৫ ঘণ্টার বিরতি নিতে বাধ্য হলাম চিটাগাং রোডের ওপার থেকে কাচপুর ব্রিজ পর্যন্ত। বিরতি শেষে গাড়ি চলতে শুরু করে মেঘনা ব্রিজ যেতেই গাড়ির সর্দি শুরু হল তাই এসি বন্ধ। গাড়ির আবার কাশিও শুরু হল। তো কাশির ধাক্কায় আমাদের পথ চলাও থেমে গেল। খুড়িয়ে খুড়িয়ে বুড়ো টিআর গাড়ি গিয়ে দাউদ কান্দিতে আমাদের রাত্রি কালীন বিরতি দিয়ে দিল। এরই মধ্যে আমাদের যা বোঝার বোঝা হয়ে গেল। এই গাড়ি যাবেনা, সে যেতে পারেনা। রিক্সার গতিতে গেলে ২০১৮ সাল চলে আসবে কিন্তু খাগড়াছড়ি যাওয়া সম্ভব হবেনা। বাধ সাধলাম আমরা যে এই গাড়িতে যাবনা।
অশেষ ধৈর্যের ফল হিসেবে ভোরে শান্তি পরিবহনের এক জরাজীর্ণ আর মেয়াদোত্তীর্ণ খুড়তুতো ভাই (ফেনী-খাগড়াছড়ি রুটে চলা গাড়ি) এসে আমাদের রক্ষা করল সময় তখন সকাল ৪ টা। ততক্ষণে সব গাড়ি খাগড়াছড়ির সিমানাতে চলে গেছে আর আমরা তখনও দাউদ কান্দিতেই। শুরু হল বিস্ময় টিআরের খুড়তুতো ভাই বেশ ভালোভাবেই থিম পার্কের ঝাকানাকা আনন্দ দিয়ে এগিয়ে চলল আমাদের নিয়ে। আমরা বেজায় লাফাচ্ছিলাম মনের আনন্দে। তবে লাফিয়ে বেশি দূর যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। কারণ লাফ জোরালো হলেও গতি কচ্ছপের শিষ্যের মতই বজায় থাকলো।
যাই হোক সকালের সূর্য উঠল আর তার সাথে সাথে আমাদের অবাক করার পালা শুরু করল প্রকৃতি। চট্টগ্রামের বাড়িয়ার হাট থেকে ভিতরে যেতেই ভালো লাগা আমাদের ঘাড়ে ভর করতে শুরু করলো। সারা রাতের ভালো জার্নির বদৌলতে মাঝে মাঝেই ঘুম আর তন্দ্রা আমাদের নিয়ে একটু খেলামেলা শুরু করলো। হঠাতই দেখি দূরে পাহাড় দাড়িয়ে আছে, যেন আমাদের ডাকছে। কিছুক্ষণ পরেই আবার আমরাই পাহাড়ের কাধে চড়ে বসলাম। ছোট্ট থেকে পাহাড় বড় হতে লাগলো আর হইহুল্লোর পড়ে গেল গাড়িতে। এই উপরে তো আবার নিচে দুরেও পাহাড় কাছেও পাহাড়, সমতলে আর পাহাড়ে চড়তে চড়তে চোখের সীমানাতে আসলো খাগড়াছড়ির একমাত্র চা বাগান। আশপাশের ঘরবাড়ি পথে পাহাড়ি কলার বিশাল বাজার আর আগে না দেখা অনেক অনেক নতুন নতুন দৃশ্য আর কির্তী দেখতে দেখতে সকাল প্রায় ১১ টার দিকে বিশাল পাহাড়ে চরলাম সেই লক্কর ঝক্কর বাসে। নিচে বাম দিকে সব ছোট ছোট আর অদ্ভুত সৃষ্টি দেখে পুরো গাড়ির সবাই আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠলো। গাড়ি থামাতে বললাম কন্ডাক্টর কিন্তু সাথের ট্রাভেল এজেন্সির এজেন্ট বলল এমন আরও অনেক পরবে সামনের পথে, কত থামাবেন গাড়ি ? আহ ! সামনে যেতেই দেখি এত দিন ইউরোপ আমেরিকাতে থাকা দৃশ্য চোখের সামনে, যেমনটা দেখি বিভিন্ন সিনেমাতে। দৃষ্টির শেষ সীমানায় নিচে পাহাড়ের তলানিতে বিশাল এলাকাজুড়ে এক বিশাল শহর দুপুরের আলোয় চকচক করছে। আহ ভালো লাগা ! অবশেষে পড়ে জানতে পারি পাশেই আলুটিলা আর আরেকটা ওয়াচ টাওয়ার আছে এই শহর পুরোটা এক সাথে দেখার জন্য। এটাই খাগড়াছড়ি শহর। আমাদের গন্তব্য।
নেমেই শুরু করলাম হোটেল খোজা। সব বুকড। তার মধ্যেই আল্লাহ সবার রিজিক যেমন দিয়ে রেখেছেন তেমনি আমাদের গাড়ি, হোটেল আর খাবারও সুন্দর করে ধাপে ধাপে হাতের কাছে এনে দিলেন। আশপাশের বাকি কয়েকটা দেখে খোঁজ নিয়ে শেষ করে জেলার সেরা হোটেলে উঠলাম। একমাত্র এই হোটেলেই সারাক্ষণ বিদ্যুতের নিশ্চয়তা আছে। রাত বারোটার পর কোথাও বিদ্যুৎ থেকেনা তাই রাত বারোটার পর অথবা অন্য সময় বিদ্যুৎ না থাকলে জেনারেটর চালিয়ে এই হোটেলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। তাই সস্তার হোটেল পেয়েও বিদ্যুতের কথা ভেবে এখানেই উঠে পড়লাম। হাত মুখ ধুয়েই খাবারের সন্ধানে বের হলাম। সবচেয়ে বাজে বিষয় হল এখানে খাবার খেতে হলে খাবারের স্বাদ আর ভালো লাগা খারাপ লাগা নিয়ে কিছুই ভাবা যাবে না। খাগড়াছড়িকে স্বাদহীন এক ভোজের শহর বলতে ইচ্ছে করছে আমার। শুধু টাকির ভর্তাই ছিল যেটার মান স্বাদ অক্ষুণ্ণ ছিল সব দোকানে। এটার মান খারাপ হতে পারেনা বলেই হয়তো খারাপ পাইনি। খেয়ে দেয়ে রওনা করলাম আলুটিলা গুহার পথে। ভালো লাগার ব্যাপার হল গাড়ি ভাড়া নিয়ে কেউই জুলুম করেনা। স্বাভাবিক মূল্য সব সময় সব গাড়িতে। উচ্চমূল্যের ব্যাপার নেই পরিবহনের খাতে। ঠকবেন না আপনি কারোর কাছেই, আমাদের চোখে সিন্ডিকেট পড়েনি। আলুটিলা যেতে শহর থেকে উপরে শহরকে ঘিরে দাড়িয়ে থাকা চার পাশের পাহাড়ি বেষ্টনী মন ভরিয়ে দিল।
আলুটিলার কৃতৃম গুহাতে নামার দীর্ঘ পথ দেখে ভয়ে অন্য সবার মতই আমিও ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। নামতেই এত পথ তাহলে উঠার পথে কিভাবে উঠবো। কিন্তু উঠার পথ নামার পথের মাত্র ১০ ভাগের এক ভাগ হবে তার বেশি নয়। অনেক মহিলা-নারী-শিশুকে দেখালাম ভয়ে নামার পথ ধরেই ফেরত আসছে। তারা বরং দ্বিগুণ কষ্ট করলো। গেট থেকে কিনে নেয়া মশালে আগুন ধরিয়ে ভিতরে গিয়ে কিছুটা আবিষ্ট হয়েই পড়লাম। তবে ধোঁয়ায় বেশ বেকায়দায় পড়তে হল। তবে গুহার অপর প্রান্তে বেশ সুন্দর কিছু দৃশ্য আছে আলোর প্রাচুর্য থাকলে বেশ ভালো ছবি তোলা যাবে এখানে। উপরে উঠে কিছু ছবি নিয়ে নিলাম আমরা। তার পর জীবনে প্রথম ঝর্ণা দেখার প্রত্যয়ে এগিয়ে চললাম।
ঝর্নার নাম রিছাং ঝর্ণা। গাড়ির ব্যাবস্থা দেখে ভীত হয়ে পড়লাম যেতে পারবতো ? সবাই বুকিং করে রিজার্ভ করে গাড়ি নিয়ে আসছে তাই একটা হাঁসফাঁস অবস্থার মধ্যে পড়ে গেলাম। প্রায় এক ঘণ্টা পড়ে একটা চান্দের গাড়ি পেয়ে গেলাম রিছাং ঝর্নার প্রবেশ পথে নামিয়ে দিল। নেমে আবার সেই একই অবস্থা। এখানেতো রিজার্ভ গাড়ি ছাড়া কোন গাড়িই নাই কিন্তু হেটে কেন দৌড়েও যাওয়া সম্ভব না। অগত্যা প্রচলিত মোটর সাইকেলে চড়ে রওনা হলাম ৩ জন দুই মোটর সাইকেলে উঠে চললাম। আমি আর জাহাঙ্গীর একটাতে উঠলাম এমন পথ যে খুব ভয় করছিল মোটর সাইকেল কিভাবে যেতে পারে এই পথে। আমরা হচ্ছি পাহাড়ের চুড়ায় মূল সড়কের উপরে আর নিচের ঘর দেখে মনে হচ্ছে বাংলা ডিকশনারির আকারের বস্তু নিচের দিকে পড়ে আছে। সেখান থেকে মোটর সাইকেল এগিয়ে চলল। মিনিট পাচেক যাবার পর হঠাৎ বৃস্টি ভেজা ইটের পথে মোটর সাইকেল এক পাল গরুকে পাশ কাটাতে গিয়ে খানিকটা স্লিপ কেটে পড়ে গেল। আল্লাহর অশেষ কৃপা আমাদের কিছুই হয়নি। আবার চলা শুরু করলাম। নামছি তো নামছিই আরও নিচে আরও নিচে আরও নিচে.........একটা জায়গাতে কিছু দোকান দেখে থামলাম আমরা। সেখানেই শেষ মোটর সাইকেল আর যেতে পারবেনা। রাস্তা বেশ খারাপ। রিছাংয়ের পথে এবার হাটা শুরু। বেশ সুন্দর পাহাড়ের মধ্যে রাস্তা বেয়ে নেমে চললাম। শেষ মেশ গিয়ে পরলাম ঝর্ণাতে যাবার জন্য তৈরি করে রাখা সিঁড়ির ধাপে। তার পড়েও মিনিট পাঁচেক হেটে নেমে গিয়ে ঝর্নার পানি পায়ে লাগলো। সুন্দর ঝর্না। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম। তবে আরও বিপত্তি ছিল যেটা আসলে ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য ভালোই লাগে। আবার পিচ্ছিল বৃষ্টি ভেজা মাটির টিলা বেয়ে তবে যেতে হবে রিছাংয়ের গোঁড়ায়। উঠলাম বেশ বিপজ্জনক পথ বেয়ে। এটাকে সবাই প্যান্ট খেকো ঝর্না বলে তার প্রমাণ আমি। আমার শক্ত পোক্ত থ্রি কোয়াটার প্যান্ট ছিঁড়ল যে ! ঝর্ণার গোঁড়া থেকে সুন্দর পিচ্ছিল পথ আছে যেটাতে গিয়ে বসলেই হল আর কিছু লাগবে না বিভিন্ন কৃত্রিম ওয়াটার ওয়ার্ল্ড আজ আপনার সামনে প্রাকৃতিক রূপে উদ্ভাসিত। দুই বার বেয়ে উঠে পিছলে নামলাম আর সেই বাল্যকালের খেলার কথা মনে করতে থাকলাম। সেই দুরন্তপনা ফিরে এলো মনের মধ্যে।
সন্ধ্যা নেমে এলো তাই আর বেশিক্ষণ থাকা সম্ভব হল না। ফিরে এলাম। আবার সেই মোটর সাইকেলে চড়েই ফিরলাম।
এবার পুরো পথ আসলাম মোটর সাইকেলে (রিছাং-খাগড়াছড়ি হোটেল পর্যন্ত)।
সময় থাকলে অবশ্যই রিছাং আর আলুটিলার মাঝে সেনা ক্যাম্পে যেতাম আর রাস্তার বিপরীত পাশেই থাকা পাহাড়ের চুড়ায় ওয়াচ টাওয়ারে চড়ে পুরো খাগড়াছড়ি শহরটা দেখতাম। কিন্তু হয়ে উঠলো না।
ফিরে হাত পা আর ছলছিল না কিন্তু সময় থাকতে ঘরে ফিরবো না এটাই ছিল প্রত্যয়। সঙ্গীরা ফিরতে চাইলেও বাধ সাধলাম। মনটানা হোটেলে গেলাম মহা মজার খাবার খেতে (অন্য বিখ্যাত হোটেল সিস্টেম অনেক দূরে তাই বাজারে থাকা এটাতেই গেলাম যেহেতু হোটেলের মোটামুটি কাছে ছিল এটা), সে কি মজা (!) আর জীবনেও ওখানে খেতে যাব না। অন্য কয়েকটাতেই খেয়েছি কোথাও স্বাদ পেলাম না শুধু টাকির ভর্তা ছাড়া।
টাটকা সবুজ মাল্টা খেলাম বেশ মিষ্টি। গেলে অবশ্যই এই জিনিসটা চেখে দেখবেন।
পরদিন সাজেক যাবো তাই গাড়ির চিন্তা মাথায় ভর করলো। গাড়ি সকালে ঠিক করার পরামর্শ পেলাম সবার কাছ থেকেই। আবার সস্তায় চাইলে সিএনজি সব চেয়ে ভালো ৩-৪ জনের জন্য। তাই গাড়ি ঠিক না করেই ফিরলাম আমরা। পথে একটা হোটেল দেখে পছন্দ হল মনে করলাম ওটাতে আর থাকবো না নতুন একটা দেখি। অগ্রিম দিয়ে গেলাম ফিরতি যাত্রার বাস ঠিক করতে। নাই নাই নাই শুধু। আল্লাহ জানে কি আছে কপালে। ফেরার পথে খবর পেলাম বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সেসব নিয়ে কথা বলতে বলতেই সিদ্ধান্ত বদলে ফেললাম ১ অক্টোবর রাতে গাড়িতে উঠার বদলে আমরা ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে ফিরে আসবো। আবার গিয়ে হোটেল ক্যানসেল করে দিলাম। ৩০ তারিখের টিকিট খুজতে গিয়ে ভাগ্যক্রমে দেখলাম মাত্র ৩ টাই সিট ফাকা আছে। হয়ে গেল। গিয়ে আরাম করে ঘুম দিলাম। ফ্যানের শক্তি কম ছিল তাই সেবাও কম দিল কিন্তু ক্লান্ত হওয়ার বদৌলতে বেজায় ভালো ঘুম হল। সকালেই খাগড়াছড়িতে থাকা আরও বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখবো বলেই সকালে উঠার কথা।
উঠলাম সকাল সাত টায়। মানে ইতিমধ্যে আমরা গুরুত্বপূর্ণ ২ ঘণ্টা নষ্ট করে নতুন কিছু দেখা থেকে বঞ্চিত হলাম। যাহোক উঠেই হাতমুখ ধুয়ে দিলাম ভোঁ দৌড় অটো রিজার্ভ করে গেলাম ঝুলন্ত ব্রিজ দেখতে।
সকালটা এত মিষ্টি যে মনে থাকবে অনেক দিন। অটোতে উঠেই পাহাড়ে তাকিয়ে দেখি মেঘ তাদের আড়াল করে রেখেছে---খন্ড খন্ড ভাসা ভাসা মেঘের চাদরে পাহাড়ের চুড়া দেখা যাচ্ছে না। অটো থামলো ছোট্ট একটা টিলার মতন পাহাড়ের সামনে। বেয়ে উঠার পরে সামনেই ব্রিজ জানিয়ে দিল অটোর ড্রাইভার। আবারও ইটের সড়ক মাড়িয়ে উপরে গেলাম। গিয়ে ঝুলন্ত ব্রিজ দেখে ৩ জনেই অভিভূত আমরা। এই ব্রিজ সত্যিই ঝুলতে আর ঝলাতে জানে। অনেক গুলা ফটো তুলে ফিরে আসলাম আমরা।
এবার প্রস্তুতি সারা দিনের জন্য। সাজেক যাচ্ছি আমরা। গাড়ি ঠিক করা হয়নি তাই চিন্তিত কিন্তু তাতে কি ভরসা আল্লাহ। অনেক গাড়ি গেল বা যাচ্ছে। আমরা ধিরে ধিরে গিয়ে এক সিএনজি ড্রাইভার মুরুব্বীকে ধরলাম একটা গাড়ি ঠিক করে দিতে। তিনি এক পিচ্চিকে দিলেন আমাদের এই এডভ্যাঞ্চারের সঙ্গী করে। বড়জোর ১৫ হবে বয়স। বেশ পাকা। ছেলেমানুষি নেই মোটেই। অন্য এক ভদ্রলোক তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে সে ছোট্ট বলে। গাড়ি ঠিক করে গোসল শেষ করে গাট্রি পেট্রা নিয়ে গাড়িতে রেখে নাস্তা করে নিলাম বাজে সাড়ে ৮ কি পৌনে ৯ টা। সময় কম ১০.৩০ এ এস্কর্ট আবার কেউ বলে ১০ টায়, অনেকেই বলল ১১ টায়। তাই মিস না হোক এই আশাতে ৯ টার মধ্যেই সিএনজি নিয়ে বেড়িয়ে পরলাম আমরা। ইচ্ছা মাঝে একটা ঝর্না, হাজাছড়া ঝর্না আছে সেটা দেখেই যাত্রা করবো।
দিঘীনালার পথে চললাম আমরা। বাজারের পরপরই একটা জায়গাতে বেটা গাড়ি থামিয়ে বলে দিল এই দিকে ১০ মিনিট হাঁটেন ঝর্না দেখে ২০ মিনিটের মধ্যেই ফিরে আসবেন। ঝর্নার পথ সমতল আর কিছুটা উচু নিচু জমি আর টিলা মতন পাহাড়ের ধার ঘেঁষে এগিয়ে গেছে। ছড়ার পানিতে পা ভিজিয়ে যেতে যেতে ভালোই লাগলো পথটা। হাজাছড়া ঝর্নাকে পিচ্চিটা বলছিল সাদাছড়া ঝর্না। অসাধারণ একটা ঝর্না। উপরে উঠার পথ করা আছে কিন্তু সাজেক মিস হবে ভেবে উঠার চেষ্টা করিনি। পানির অবিরাম গড়িয়ে পরা দেখে অভিভূত হয়ে রইলাম যতটা সময় ছিলাম। ভালো লাগা নিয়ে ফিরলাম সিএনজি তে। জয়নাল ছেলেটার নাম। নির্ভিক আর চতুর এবং বুদ্ধিমানও বটে। তবে ধোঁকাবাজি বা চালাকি করার মানসিকতা দেখিনি তার মধ্যে। আর্মি এস্কর্টের জন্য অনুমতি নিয়ে এগিয়ে গেলাম আমরা। একটা কাঠের আরত পেলাম ঠিক যেখানে গিয়ে লাইনে দাঁড়ালো গাড়ি তার ২০ গজ আগে। ২০ টা করে গাড়ি ছাড়ে এক সাথে। হয়েছে ৬ টা তাই দৌড়ে গেলাম কাঠের আড়ত দেখতে। চেঙ্গি নদীর পারে এই কাঠের আড়তটা। ওপারে অপার ভালো লাগা নিয়ে পাহাড়ি গ্রামটা তার সাথে ঘোলা পানির নদিতে বয়ে চলা বাঁশের সারি আর ঢেউয়ের আঘাতে ভাঙা নদীর পার দেখে মনে হল প্রতিটা মুহুর্ত কাজে লাগানোই বুদ্ধিমানের কাজ।
এবার সাজেক যাত্রা।
জয়নাল পিচ্চি হলেও গাড়ি যে ভালো চালায় সেটা বুঝা শুরু করলাম পাহাড়ের গায়ে চড়ার শুরু হতেই। বিপজ্জনক পথ হবে সেটা জানাই ছিল। তবে বড় বিপদের ব্যাপার হল হঠাৎ করেই রাস্তা নিজের মুখটা বামে বা ডানে ঘুরিয়ে নিয়েছে অনুমান করার উপায় নেই বা দেখার সুযোগ নেই যে সামনে কিছু আছে নাকি নেই বা নিচেই নামবো নাকি রাস্তা উপরে উঠতে যাচ্ছে। হর্ন না বাজালে দুর্ঘটনা নিশ্চিত। হঠাৎ করেই দেখা গেল শুকর ছানা বা ছাগল অথবা মানুষের বাচ্চা রাস্তার এপার থেকে ওপারে যাচ্ছে। এই পাহাড়গুলো যে ছোট ছিল তা কেবল ৩০ মিনিট পরেই বুঝলাম। সব ফেলে উঁচুতে চড়া শুরু করলাম যখন তখন দেখি উপরে আরও উপরে আরও উপরে পাহাড় মাথা এগিয়ে রেখেছে। একটা বনবিহার পেড়িয়ে গেলাম। যাবার আগেই গবেষণা করেছিলাম বান্দরবান নিয়ে গেলাম খাগড়াছড়ি। তাই গবেষণা পরিপূর্ণ ছিলনা এই জায়গার সব কিছু নিয়ে। বনবিহারটা দেখবার মতন হলেও। অন্য সবাই আর জয়নাল থামতে রাজি না। অগত্যা আমার যা দেখছিলাম তাই নিয়ে খুশি থাকতে হল।
মাঝে বাঘাইহাট বাজারে কিছু কলা আখ ইত্যাদি নিয়ে চললাম আবার। জায়গাটা ভালো লাগলো। কিন্তু থামার জো নেই। এগিয়ে চললাম সাজেকের পথে।
বিশাল উচু পাহাড়ের চুড়ায় অবস্থিত সেই সাজেক আর তার ঘর বাড়িগুলো ক্ষণিকের জন্য চোখের সীমানাতে আসলো। তার আগেই একটা বিশাল পাহাড় ডানে দেখলাম মনে হল ওটাতে উঠে দেখি সারা রাঙামাটি আর খাগড়াছড়ি। এর মধ্যে সাথে থাকা সাজেক তথ্যের একটা লেখাতে পড়লাম সাজেক সমতল থেকে ১৮০০ মিটার উপরে অবস্থিত। যার দৈর্ঘ্য প্রস্থ মানে আয়তন ৭০২ বর্গমাইল। এটুকু পড়েই আমি কাত ! বলে কি রে ! কয়েকটা জেলার মোট আয়তন এক করলেও এত হবেনা। আমরা খাগড়াছড়ি থেকে যেতে পার হলাম ৬৭ কিলোমিটার, আর পুরো সাজেকই ৭০২ বর্গকিলোমিটার। সাজেকের উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা , দক্ষিনে রাঙামাটির লংগদু ,পূর্বে ভারতের মিজোরাম , পশ্চিমে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা । সাজেক রাঙামাটি জেলায় অবস্থিত তবে যাতায়াতের সুবিধা হবে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা থেকে গেলে। রাঙামাটি থেকে নৌপথেও যাওয়া যায় সাজেকে।
তখন হয়তো মাত্র ৫০০ কি ৭০০ মিটার উপরে আমরা সিএনজি চলেছে দুর্বার গতিতে। বেশ ভালো লাগছে প্রকৃতির মধ্যে দিয়ে আঁকাবাঁকা পথে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলা। আর ৩০ মিনিট বাকি কিন্তু সাজেকের লাল ঘরটা দেখা যাচ্ছে একটু একটু করে ভাবলাম জয়নাল বাড়িয়ে বলছে সময়টা। কিন্তু যেতে ৪০-৪৫ মিনিট বা তার বেশি লেগে গেল। এতটা খারা পাহাড়ে উঠবো তা ভাবতেও পারিনি। ভাবছিলাম কেউক্রাডং, নীলাচল গেলে আমার কি হাল হত। একটানা ১০ মিনিট শুধু উপরেই উঠে গেলাম আমরা। আবার নামা উঠা শেষে একটা জায়গাতে থেমে গেলাম। বেশির ভাগ গাড়িই এখানে বিশ্রাম নিচ্ছে। ইঞ্জিন ঠাণ্ডা করে নিচ্ছে পানি দিয়ে অথবা একটু সময় বিরতি দিয়ে। আমাদের পিচ্চিটা অনুমতি নিয়ে গাড়ি থামালো। বেশ ভালো আর সুন্দর জায়গাটা। পানির শব্দে মনে হল পিছনে নদী হতে পারে তবে আমার মনে হয়েছে ঝর্না হতে পারে। একটা স্কুল, বাংলার অবিরাম এগিয়ে চলারই নামান্তর এই স্কুলের সামনের একটা জীর্ন বাঁশে বাংলাদেশের পতাকার পত পত করে উড়ে চলা। স্কুলটা খুবই ভালো লাগল। ছোট ছোট বাচ্চাগুলো নিজেদের ভাষায় কিছু একটা পড়ছিল। ভিতরে মেঝেতে একটা কুকুর মনের সুখে ছায়ায় ঘুমাচ্ছিল। কেউ কিচ্ছু বলছিল না। জাহাঙ্গীর ভাইকে বললাম কয়েকটা ছবি তুলে নিতে নিয়ে নিলেন। পড়ে সামনের বিশাল সাইজের টন খানে অজনের পাথরের উপরে বসে একটা পোজ দিয়েই ফেললাম। সুন্দর ছবি তুলে দিলেন জাহাঙ্গীর সাহেব।
আবার পাহাড়ে চড়া শুরু হল আমাদের। আর বিরতির জায়গা বা সুযোগ নেই। এক বারে পাহাড়ের মাথায় উঠেই সাজেকের প্রবেশ পথে থামলাম আমরা। আর্মির হিসাব নিকাশ শেষে আমরা রুইলুই পাড়াতে প্রবেশ করলাম। যাবার পথে খাবারের অর্ডার করে গেলাম অগ্রিম টাকাসহ। তা না হলে আবার খাবার পাওয়া যাবে না। এখানেই দুইটা ঝর্না আছে ডান দিকে একদম নিচের দিকে। মানে ১৮০০ মিটার নিচে হবার কথা ঝর্না। সঙ্গিদের দুঃসাহসের অভাব এবং নির্দিস্ট থাকা সময়ের কারণে আর এই ঝর্নার এডভেঞ্চারের ভাবনাকে বাস্তবে রূপান্তর করা গেল না। ঝর্নার নাম - কমলাক আর শেষটা সিকাম তুইসা। আবার গেলে নিশ্চিতই হাতে সময় নিয়ে ১ সপ্তাহের জন্য যাব। খাগড়াছড়ির এগার (১১) ঝর্না, সব বন বিহার আর সাজেকের অলিগলির সব ঝর্না আর পাহাড় মাড়িয়ে তবেই ফিরবো ইনশাল্লাহ।
হ্যালিপ্যাডের গোঁড়ায় নামিয়ে দিল আমদের জয়নাল। সে কি পোজ আর ছবি তোলার মহড়া এখানে। মনে মনে বিরক্ত হচ্ছিলাম সঙ্গীদের প্রতি সময় নষ্ট হচ্ছিলো বলে। কারণ আমি এখানে আসিনি। আরও যতটা সম্ভব যত রাস্তা গেছে তত পথ রাস্তা পার হব এই হল বাসনা।
উদ্দেশ্য কংলাক পাড়া। মাত্র ৬-৭ মিনিটের রাস্তা হবে (হাটার বা ট্র্যাকিং করা জন্য বাঁশ বিক্রি করছিল একটা ছেলে সে জানালো এটা, আর আমি ঘাটাঘাটি করে আগেই জেনেছি এখান থেকে যেতে স্বাভাবিকভাবে কম করে হলেও ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা লেগে যাবে) রুইলুই থেকে কংলাক পাড়া বেয়ে বেয়ে উঠলাম বলা চলে। রিপন ভাইয়ের কষ্ট হচ্ছিল তবে তাঁর মনের জোর ছিল ব্যাপক, ধীরে ধীরে উঠে এলেন সাজেকের সর্বোচ্চ চুড়ায়। যেখান থেকে নিচের প্রতিটা পাহাড় দেখা যায় একদম স্পষ্টভাবে। মাঝে একটা বাচ্চা এসে মিনতি করলো স্কুলে যায় বই কিনতে টাকা লাগবে। প্রাইমারীতে বই কিনতে হয়না তবু দিলাম ২০ টাকা। বাহ টাকাটা নিয়ে সামনেই দোকানে গিয়ে দোকানদারকে দিয়ে দিল বলল ২০ টাকা পাইছি ঐ যে ওরা দিছে। বাপকে বুঝিয়ে দিল। আহ জীবনে আরেকটা ভুল করলাম। আরেকটা পিচ্চি এসে পায়ে জড়িয়ে ধরল টাকা দিতে কিন্তু মন আর গলাতে পারলো না। মাত্রই তো ধোঁকা দিল অন্যজন।
কংলাকের উঠার পথ মানে একদম শেষ ধাপে গিয়ে উপরে উঠার সিঁড়িটা বেশ ছোট আর বিপজ্জনক। খুব ভয়ে ভয়ে উঠেছি। বাহ উপরে গিয়ে দেখি ৩-৪ বছরের এক বাচ্চা মেয়ে উঠে বসে আছে। নিজের পায়েই উঠতে দেখেছি। তবে ফেরার পথে একটা ৭-৮ বছরের মেয়ে বাচ্চা স্লিপ করে পড়েছিল এসি শেষ ধাপটা থেকে। সামনেই পড়েছিল একদম নিচে পড়ে যায়নি বলে রক্ষা। অনেক লোকজন আর সেরা কটেজগুলো দেখতে পেলাম। কিছু স্থানীয় আদিবাসী দেখলাম তাদের বাড়িতে বিভিন্ন কাজে ব্যাস্ত। ভালো লাগলো। তারও উপরে একটা চুড়া আছে যেখানে একটা কটেজ আছে। সেটার কাছ থেকে ঘুরে চলে আসলাম সময় সল্পতার কারণে। রুইলুইতে প্রবেশ করেছিলাম দুপুর ১ টায় আর ফিরেছি ৩ টায় আর দীঘিনালাতে ছিলাম ১১ টার সময়। আবার রাতে গাড়ি রাত ৯ টার সময়। মাত্র ২ ঘণ্টার মধ্যে খতম করলাম সাজেক-কংলাক দৌড়াদৌড়ি।
ফেরার পথে কংলাক থেকে ডানে বাঁয়ে সুন্দর সুন্দর দৃশ্য মনটা ভরিয়ে রাখল। দূরে পাহাড়ের কোলে কালো মেঘের রাজ্য দেখলাম। কিছু সাদা মেঘও হানা করলো তাদের। সেদিকে খাগড়াছড়ি শহর বা দিঘীনালা। ভাবলাম আজ বৃষ্টি সব মাটি করে দিবে। মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যেই কংলাকের কাছেই মেঘের ভিতরে প্রবেশ করলাম আমরা। ছবি তুলে একাকার অবস্থা আমাদের সবার। ফ্রিজের মধ্য দিয়ে হেটে চললাম। মনে হল মাথার উপর থেকে যা যাচ্ছে সুগুলো থেকে বৃষ্টি হবেনা। হলনা। কিছুক্ষণ পর দেখে হাঁটুর নিচের জায়গাতে যে মেঘ সেগুলা থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে মাটি ভিজে যাচ্ছে। গুড়ি বৃষ্টি। সে এক অন্য অনুভূতি। এর মধ্যে দিয়েই হাঁটতে হাঁটতে সাজেকের কাছে চলে আসলাম মোটামুটি ভালো বৃষ্টি পেলাম। তবে খাগড়াছড়িতে গিয়ে যে পরিমাণ বৃষ্টির প্রমাণ পেলাম টার ১ শতাংশও হয়নি সাজেকে।
সাজেকের সেই খাবারের কথা আমি সহজে ভুলবো না। মুরগী, ডাল, লেবুর জুস, আর চিংড়ী লাউ.........জীবনের সেরা খাবারের সেরা স্বাদ মনে হল।
ফেরার পথে আর্মির তদারকি চৌকি বা এস্কর্টের জায়গাতে একটা বিশাল গাছ যেটা মনে হয় ১০ জন, অন্তত ৫ জন বেড় দিয়ে ধরতে পারা অসম্ভব এমন একটা গাছের সামনে বেঞ্চের কাছে দাড়িয়ে মেঘের ভেসে বেড়ানো দেখলাম শেষ বারের মত। ৩ টা ১০ এর দিকে রওনা করলাম খাগড়াছড়ির পথে। ফেরার পথে উল্টো পথে আবার পাহাড়ি সৌন্দর্য্য দেখতে দেখতে ফিরে আসলাম দীঘিনালা। নামার পথে পিছন ফিরে উচু পাহাড়ের মাথায় সাজেককে দেখার সুযোগটা কাজে লাগালাম ভালোমতই। দীঘিনালার আগেই একটা জায়গাতে পাহাড় থেকে আমরা একদম নিচে সমতলের কাছাকাছি একটা সেতুতে এসে একটু বিরতি নিলাম। চেঙ্গি নদীর আরেক রূপ এখানে পেলাম। বিকেলের আলোয় লক্ষাধিক বাঁশের সারি নদীর বুকে ভাসানো। বাধা হচ্ছে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা করার জন্য শেষ প্রস্তুতি। এত্ত বাঁশ জীবনে এক সাথে দেখিনি। নদীর উপরের ব্রিজ থেক দক্ষিণে নদীর মুখ একটা কিন্তু বেড় হয়ে গেছে ২ টা দিকে। অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য। মাঝের জায়গাটাতে ঘরবাড়ি, জঙ্গল। কিছু ছেলে বসে ছিল ব্রিজের উপরে, বেশ শক্তিশালী আর সুঠাম দেহের অধিকারী। সিএনজি ড্রাইভার একটু ভয় পেলো আর আমাদেরও বলল দ্রুত চলেন এই জায়গাটা নিরাপদ না। এখানে প্রায়ই উল্টা পাল্টা ঘটনা ঘটে। ফিরে এলাম দ্রুতই।
আর্মি চেক আর তথ্য যাচাইয়ে লোকজন বেশি হবার ফলে একটু ঢিলেঢালা ভাব ছিল। আমাদেরও তাড়া নেই সাড়ে ৪ টার মত বাজে আর ১-১.৫ ঘণ্টা লাগবে খাগড়াছড়ি পৌঁছাতে। তার পর ভাবলাম দীঘিটা দেখে যাব, সাথে সুইজারল্যান্ড নামক গ্রামটাও দেখবো সন্ধ্যার আগেই। কিন্তু কি কপাল ৩ ঘণ্টার একটা বিপদে পড়লাম শহরের প্রবেশমুখে। বাশের ট্রাক বৃষ্টির ফলে সৃষ্ট গভীর কাদার ভিতরে দেবে গেছে। ওদিকে বাস পাবো কিনা সেই চিন্তাতেই ক্লান্ত আমরা। হুম, জনগণের সেবা করেছি তার মধ্যেই। ট্রাকের অপর পাশে গিয়ে সিএনজি ঠিক করলাম কিন্তু গুরুতর অসুস্থ রোগীর জন্য আমরা আর সেটা ঠিক ছেড়ে দিলাম। ভালো কাজে বাকি দুজনকেও পেলাম। ৭.৩০ বেজে গেলো শহরে পৌঁছাতে। গিয়ে হাতমুখ ধুলাম বাস কাউন্টারের বাথরুমে। তার পড়ে বাসে চড়ে বসলাম আর ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে থাকলাম।
বাস ৯ টায় তাই ১০ মিনিটে খেয়ে দেয়ে ৯ টার আগেই বাসে উঠলাম। বাস ছাড়ল ১৫-২০ মিনিট পরে। শহরের মুখে একটা জায়গাতে গিয়ে সব গাড়ি সারি বেধে দাঁড়ালো পুলিশের গাড়ি বা আর্মির গাড়ি সামনে থেকে এস্কর্ট দিয়ে নিয়ে যাবার কথা শুনলাম। গাড়ি ছাড়তে ছাড়তে ১০ টা। শুরু হল আরেক অবিস্মরণীয় বাস ভ্রমণ। ইকোনো পরিবহণের বাস। ভালো সার্ভিস। ভালোটা শুরুতেই প্রমাণ করলেন ড্রাইভার সাহেব- সামনে থাকা হানিফ পরিবহনকে প্রথম টানেই পিছনে ফেলে দিলেন, তার পর শ্যামলী, নিজের ঘরের অন্য গারিগুলোকেও পিছনে ফেললো ১০-১৫ মিনিটের মধ্যেই। আমরা প্রথমে খুশি হলেও পরে ভীত হয়ে পড়লাম কারণ আমরা এই পাহাড়ের চুড়ায় উঠে রোলার কোস্টারের স্বাদ বা অনুভূতি পেতে চাইনা। বড় কথা হল জীবনটা এমন ভাবে হারাতে চাইনা যেভাবে হারালে আমাদের আর খুঁজেও পাবার আশা থাকবে না।
বেটা পুরা পাহাড় উড়ন্ত গতিতে চালিয়ে গেল কিছু গাড়িকে পাশ কাটাতে ব্যার্থ হল রাস্তা চিকন হবার কারণে। তার আসল রূপ দেখলাম বাড়িয়ার হাটে পৌছার পরে। গাড়ি সব খেলনা গাড়ির মত আমাদের দুই পাশ দিয়ে শো শা শব্দে পিছনে পরতে থাকলো। গাড়িতে চিল্লাচিল্লা শুরু হল। এই চিল্লাচিল্লি শুনে এক ভদ্রলোক ভাই পিছনের ভাইদের বললেন "সারা বছর মাটির ব্যাংকে টাকা জমিয়ে পরে খাগড়াছড়ি আসেনতো তাই এমন কাউকাউ শুরু করছে এগুলি। এই পথে মাঝে মাঝেই আসি তাই জানি গাড়ি কিভাবে চলে। এসব ফালতু লোক এখানে আসে কি করতে !" রাগে গা জ্বালা করছিল আমার। কিচ্ছুই বললাম না। সাথের লোকদেরও পরিবার পরিজন আছে আমার বাপ মা ও আছেন।
যাহোক আমাদের জাহাঙ্গীর ভাই গৌরীপুর নেমে বাড়ি চলে যাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যখন বাস ছাড়তে ১০ টা বেজে গেছিলো তখনই। কিন্তু যখন দেখল চোখ বন্ধ করে আবার খুলতে খুলতেই সামনে ফেনী চলে আসছে তখন বাড়ি যাবার কথা ছেড়েই দিলেন। কিছুটা ঘুমের চেষ্টা হল জ্যাম আর গাড়ি বেশি থাকাতে ড্রাইভার সাহেব বাধ্য হয়ে স্পিড কমানোর ফলে। বেটার মাতব্বুরির কল্যাণে সকাল ৬ টা যেখানে বাজার কথা ঢাকা পৌঁছাতে সেখানে কাচপুর নামলাম রাত ৪ টার সময়। এখন নরসিংদী যাবার গাড়ি পাওয়া সম্ভব না। তাই মামুর বাড়ির পথে হাঁটলাম। সকালে খেয়ে দেয়ে নরসিংদী গেলাম। চরম এক ভ্রমণ শেষ হলো দুর্দান্ত কিছুর ঘটনার মধ্য দিয়ে। আল্লাহ সবাইকে নিরাপদে ভ্রমণের তাওফিক দান করুন।
সবচেয়ে বেশি যার নাম স্মরণ করেছি এই বিস্ময়কর ভ্রমনজুরে তিনি আমার আল্লাহ। শুকরিয়া তাঁর কাছে আমাকে এই সুযোগ করে দেয়ার জন্য।






































Comments

Popular posts from this blog

Goat Farming in Bangladesh || বাংলাদেশে ছাগল পালন ।। ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন || Black Bengal Goat Farming