বায়তুল মোকাররম মসজি নির্মাণের ইতিকথা

বায়তুল মোকাররম মসজি নির্মাণের ইতিকথা বাংলাদেশী মাত্রই আমরা জানি যে আমাদের দেশের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাঙলা আমি তোমায় ভালবাসি।’ আমাদের জাতীয় ফুল শাপলা, জাতীয় ফল কাঁঠাল কিংবা পাখী দোয়েল ইত্যাদি। তেমনি আমাদের জাতীয় মসজিদের নাম ‘বায়তুল মোকাররম’। এটি ঢাকায় অবস্থিত। এর বর্তমান ধারন ক্ষমতা ৪০,০০০।কিন্তু যখন এটি নির্মাণ করা হয়েছিল তখন এর ধারন ক্ষমতা ছিল ৩০,০০০। বায়তুল মোকাররম মসজিটি পৃথিবীর ১০ম বৃহত্তম মসজিদ হিসেব বিখ্যাত। বায়তুল মোকাররম মসজিদ নির্মাণের পিছনে কিছু চমকপ্রদ ঘটনা আছে যা আমরা অনেকেই হয়তো জানিনা ।এখানে কিছু তথ্য উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হলো মাত্র: কথিত আছে যে, পন্চাশ/ষাট দশকে তৎকালীন ঢাকার এক শ্রেনীর অভিজাত নাগরিকদের বসবাস ছিল পুরানা পল্টন, সেগুন বাগিচা এলাকায়। ঐ সময় দ্রুত ঢাকা শহরের বিস্তার ঘটছিল, বিশেষ করে শহরের উত্তরাংশে। তখনকার ঢাকার মূল নক্সা অনুসারে সদর ঘাট থেকে সোজা উত্তর দিকে যে নবাবপুর রোডটি গুলিস্থান এলাকা হয়ে বায়তুল মোকাররম মসজিদ এর দিকে চলে গেছে , সেটি ডানে বামে কোথাও মোড় না নিয়ে বায়তুল মোকাররম মসজিদ বরাবর (তখনও মসজিদ নির্মাণ হয়নি) পুরানা পল্টন-সেগুন বাগিচা এলাকার উপর দিয়ে আরো উত্তরে চলে যাবার কথা ছিল, এতে অভিজাত শ্রেনীর অনেক নাগরিকের আবাস্থলের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। এমতাবস্থায় উক্ত এলাকায় বসবাসরত অবাঙ্গালী ধনিক শ্রেনীর নেতৃত্বস্থানীয় কিছু ব্যাক্তি রাতারাতি বর্তমান স্থানে মসজিদ নির্মাণ করার পরিকল্পনা গ্রহন করে তৎকালীন সামরিক শাসক আইয়ুব খানের নিকট একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করে। যুক্তি হিসেব তারা উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে বোঝায় যে, পুরাতন এবং নতুন ঢাকার সংযোগস্থলেই ঢাকা শহরের কেন্দ্রীয় মসজিদ নির্মাণ করা অধিকতর যুতসই হবে। এতে নতুন ও পুরাতন ঢাকার সকলেই এই মসজিদের সুবিধা ভোগ করতে পারবে।উল্লেখ্য গুলিস্থান হতে দক্ষিনে ঢাকার মূল শহর যা পুরাতন ঢাকা হিসেবে পরিচিত ছিল এবং গুলিস্থান হতে উত্তরে তখন নতুন শহর অর্থাৎ নতুন নতুন আবাসিক এলাকা এবং অফিস ও বানিজ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছিল। সামরিক প্রশাসন এই প্রস্তাব গ্রহন করে মসজিদ নির্মাণের সকল খরচ ব্যাবসায়ী মহলকেই বহন করতে অনুরোধ করে। এ প্রেক্ষিতে বিশিষ্ট ব্যাবসায়ী আব্দুল লতিফ ইব্রাহীম বাওয়ানী সর্বপ্রথম মসজিদটি নির্মাণের সম্পূর্ণ অর্থ যোগানের দায়িত্ব গ্রহনে আগ্রহ প্রকাশ করেন। সে মোতাবেক এটি নির্মাণের কাজ তদারকি ও সমন্ময় সাধনের জন্যে ১৯৫৯ সালে ‘ বায়তুল মোকাররম মসজিদ সোসাইটি’ নামে একটি কমিটিও গঠন করা হয়। ঢাকায় বসবাস করেন তখনকার অনেক বিশিষ্ঠ জনের ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে এবং তাঁদের বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, বায়তুল মোকাররম মসজিদটি যেস্থানে নির্মিত হয়েছে সে স্থানটিতে একটি বড় পুকুর ছিল এবং পুকুরটির নাম ছিল ‘ পল্টন পুকুর ‘।এছাড়া পুকুরটির পার্শ্ববর্তী খোলা জায়গাটি মূল শহরের সীমানার বাইরে ছিল বিধায় (তখনও নতুন শহর গড়ে ওঠা শুরু হয়নি) পুরাতন শহরের সকল ময়লা আবর্জনা এখানে ফেলা (Dumping Place) হতো। কালের আবর্তে ময়লা ফেলতে ফেলতে পুকুরটিও প্রায় ভরাট হয়ে গিয়েছিল। বায়তুল মোকাররম মসজিদের নক্সা ও নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয় ‘ আব্দুল হোসেইন এম. থারিয়ানি এন্ড কোম্পানী ‘ কে। থারিয়ানি এন্ড কোম্পানী সে সময়ে বেশ সুনামধন্য একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত ছিল। এ প্রতিষ্ঠানটি ‘ঢাকা নিউ মার্কেট, ‘শাহবাগ হোটেল’ (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় বা পিজি হাসপাতাল ), তৎকালীন আদমজী গ্রুপের হেড অফিস ‘ আদমজী কোর্ট বিল্ডিং’ এবং ‘ডিআইটি বিল্ডিং(বর্তমানে রাজউক) নির্মাণ করে সুনাম অর্জন করে। বায়তুল মোকাররম মসজিদের নক্সা করার সময় মসজিদকে কেন্দ্র করে বায়তুল মোকাররম মার্কেট , অফিস, লাইব্রেরি, গাড়ী পার্কিং এবং দক্ষিন প্রান্তে আগ্রার তাজমহলের সম্মুখভাগের একাধিক ছোট ফোয়ারা শোভিত পানির আধারের ন্যায় লম্বা পানির আধার সম্বিলিত মসজিদ কমপ্লেক্স নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। পবিত্র কাবা শরীফ প্রতিটি ধর্মপ্রান মুসলিমের নিকট অতি পবিত্র একটি স্থান বিবেচিত। কাবা শরীফ কে কেন্দ্র করেই মুসলমানগন পৃথিবী যে যে প্রান্তেই অবস্থান করুন না কেন নামাজ আদায় করে থাকেন।এছাড়া কাবাঘরের ছবিটি সকলেই নিজ নিজ অন্তরে ধারন করে থাকেন যেন চক্ষু বন্ধ করলে চোখের ভেতর পবিত্র কাবা শরীফের দৃশ্যটি ভেসে উঠে।যেহেতু বায়তুল মোকাররম মসজিদটি হবে ঢাকার কেন্দ্রীয় মসজিদ এবং পবিত্র স্থান; এ কথা চিন্তা করেই বায়তুল মোকাররমের বহি:দৃশ্যটি (Out look) যেন কাবা ঘরের মত দৃশ্যমান হয় এবং দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম স্থাপত্যের ঐতিহ্যেরও যেন প্রতিফলন ঘটে সে কথা বিবেচনায় রেখে পবিত্র কাবা শরীফ ও মোঘল স্থাপত্য কলার সমন্ময় ঘটিয়ে বায়তুল মোবারক মসজিদের স্থাপত্য নক্সাটি করা হয়। কাবা শরীফের ন্যায় বায়তুল মোকাররম মসজিদের মূল অংশে কোন ডোম নেই, কিন্তু দক্ষিণ এশিয়া সহ পৃথিবীর অন্যান্য অন্চলে সাধারণত ডোম সম্বলিত মসজিদ হয়ে থাকে, একথা ভেবে মূল কাঠামোয় ডোম না রাখলেও ডোমের অভাব পূরনের জন্য বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর ও দক্ষিণের প্রবেশ পথে দুটি ডোম সম্বিলিত প্রবেশ দ্বার নির্মাণ করা হয়। যদিও মূল নক্সা অনুযায়ী মসজিদের প্রধান প্রবেশ পথটি পূর্বদিক থেকেই হবার কথা ছিল। বায়তুল মোবারক মসজিদ ৮ তালা বিশিষ্ট এবং এর উচ্চতা ৯৯ ফুট। মসজিদের নীচ তালার মূল নামাজের স্থানটি ২৬,৫০৭ বর্গফুট। এর পূর্বদিকে আরও ১৮৪০ বর্গফুট জায়গা রাখা হয়েছে নামাজ পড়ার জন্য। এছাড়াও মূল কাঠামোর বাইরে পূর্বদিকে আরও ২৮,৯৮৭ বর্গফুট খোলা জায়গা নামাজ পড়ার জন্য রাখা হয়েছে। ১৯৬০ সালের ২৭ জানুয়ারী বায়তুল মোকাররম মসজিদের নির্মাণ কাজের উদ্ভোধন করে প্রথম পর্যায়ে দোতালা পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়। পরবর্তিতে বিভিন্ন চড়াই উতরাই পেড়িয়ে ১৯৬৮ সালে বায়তুল মোকাররম মসজিদের কাজ সম্পূর্ণ হয়।বায়তুল মোকাররম মসজিদের প্রধান স্থপতি ছিলেন ‘ আব্দুল হোসেইন এম. থারিয়ানি এন্ড কোম্পানী ‘ এর স্বত্বাধিকারী মি: আব্দুল হোসেইন মোহাম্মদ থারিয়ানি’র পুত্র মো: সেলিম থারিয়ানি । ১৯৬৩ সালে বায়তুল মোকাররম মসজিদে প্রথম নামাজ পড়া শুরু হয় এবং ১৯৬৪ সাল হতে বায়তুল মোকাররম মার্কেট চালু হয়। কথিত আছে তৎকালীন বিশিষ্ঠ ব্যাবসায়ী আব্দুল লতিফ ইব্রাহীম বাওয়ানী একজন জাত ব্যাবসায়ী ছিলেন। বায়তুল মোকাররম মসজিদ নির্মাণে তিনি যত অর্থ খরচ করেছিলেন বায়তুল মোকাররম মার্কেট এর নীচ ও দোতালার সকল দোকান বিক্রির মাধ্যমে তা তুলে নিয়ে গেছেন। শুধু তাই নয় ঢাকাবাসীকে তিনি বায়তুল মোকাররম মসজিদের মত একটি মসজিদ উপহার দিতে পেরেছিলেন, একইসাথে পুরানা পল্টন ও সেগুন বাগিচায় বসবাসকারী অবাঙ্গালী অভিজাত শ্রেনীর নাগরিকদের আর্থিক ক্ষতি হতে রক্ষা করে তাদের স্বার্থও রক্ষা করেছিলেন। একারনেই গুলিস্থান হয়ে নবাবপুর হতে আগত রোডটি বায়তুল মোকাররম কমপ্লেক্সের দক্ষিনে হটাৎ বাঁক খেয়ে পশ্চিম দিকে চলে গিয়ে জিড়ো পয়েন্টে গিয়ে গোলাপ শাহ্ মসজিদ হতে আগত রোডের সাথে মিলিত হয়ে বিজয় নগরের দিকে চলে গেছে । https://www.facebook.com/groups/1940416746193270/user/720117981/

Comments

Popular posts from this blog

Goat Farming in Bangladesh || বাংলাদেশে ছাগল পালন ।। ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন || Black Bengal Goat Farming

পাহাড়ের টানে খাগড়াছড়ি-সাজেক || সাজেক ভ্রমণের বৃত্তান্ত